লিচু গাছে কখন ফুল আসে

সবচেয়ে ভালো জাতের লিচু কোনটি

লিচু মূলত গ্রীষ্মকালের এক অত্যন্ত সুস্বাদু একটি ফল। এর মিষ্টি স্বাদ আমাদের তৃপ্তি দেওয়ার সাথে সাথে শরীরেরও বিভিন্ন উপকারিতায় সহযোগিতা করে। এখন আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকতে পারে আমাদের দেশের মধ্যে ভাল জাতের লিচু কোনটি। সাধারণত আমাদের দেশে বেশিরভাগ তিন ধরনের লিচু চাষ করা হয়, যেমন দেশি লিচু, বোম্বাই লিচু এবং চায়না ৩ লিচু। চায়না ৩ লিচু এটি অন্যান্য লিচুর চেয়ে আকার একটু বড় এবং এর স্বাদও অন্যান্য লিচুর চেয়ে তুলনামূলকভাবে রসালো।

তাই আমাদের দেশের উৎপাদন করা লিচুগুলোর মধ্যে চায়না ৩ লিচুকেই সবচাইতে ভালো জাতের লিচু হিসেবে ধরা হয়। কারণ চাইনা ৩ লিচু আকারে বড়, মিষ্টি রসালো সাধ এবং দেরিতে পাকার কারণে চাষিরা এটিকে বেশি লাভজনক বলে মনে করেন। এই লিচুটি মূলত বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই চাষ করা হয়, কিন্তু বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা এই অঞ্চলগুলোতে বেশি চাষ করা হয়। মোটকথা যারা আকারের বড় স্বাদ এবং বাজার মূল্যর দিক থেকে লিচু চাষ করতে চান তাদের জন্য চায়না ৩ লিচু চাষ করা অত্যন্ত লাভজনক এবং কার্যকরী হবে। 

লিচু কোন পরিবেশে ভালো হয়

লিচু আমাদের দেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এদেশের অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক একটি ফল। তাই লিচুর উচ্চ ফলনের জন্য লিচু গাছের পরিবেশ এবং সে অনুযায়ী যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি লিচু প্রায় বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই চাষ হয়, কিন্তু কিছু কিছু অঞ্চল আছে যেমন দিনাজপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ইত্যাদি এই অঞ্চলগুলোতে লিচু বেশি চাষ হয়। কিন্তু এখানে উচ্চ পরিমাণে লিচুর ফলন বেশি হওয়ার কারণ আমরা অনেকেই জানিনা।

সাধারণত লিচু গাছের ভালো ফুল আসার জন্য বা এখান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে লিচু ফলানোর জন্য, সঠিক তাপমাত্রা, আবহাওয়া এবং গাছের পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যের আলো পৌঁছায় এবং গাছের নিচের দোয়াস মাটিতে লিচুর ভালো ফলন হয়। মোটকথা দোআঁশ মাটিতে, সূর্যের আলো বাতাস পৌঁছায় এমন জায়গায় এবং নিয়মিত গাছের গোড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে নির্দিষ্ট পরিমাণে সার দিলেই লিচুর ফলন ভালো হয়। তাই আমাদের উচিত প্রতি বছর লিচু গাছের ফুল আসার আগে গাছের নিচে নিয়মিত পানি দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং প্রয়োজনে কীটনাশক ব্যবহার করা যাতে কোন পোকামাকড় গাছের ফুল নষ্ট করতে না পারে।

লিচু গাছে কখন পানি দিতে হয়

লিচু গাছে উচ্চ ফলনের জন্য সঠিক সময়ে পানি দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত পানি গাছের সুস্থতা, বৃদ্ধি এবং উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত লিচু গাছের ক্ষেত্রে যখন লিচুর ফুল আসে ওই সময়ে সঠিক পরিমাণে পানি দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি লিচু গাছের ফুল সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যেই এসে থাকে। তাই এই সময় আমরা যদি সকালে এবং বিকেলে নিয়মিত গাছের গোড়ায় পানি দেই, তাহলে গাছ আরো সুস্থ হবে, স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ফুল আসবে যা উচ্চ ফলনের জন্য কার্যকরী।

আরো পড়ুনঃ সকালে ব্যায়াম করার ১০ টি উপকারিতা

তবে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে অতিরিক্ত পরিমাণে পানি দিলে বা সব সময় গাছের গোড়ায় বেশি পানি দিয়ে রাখলে ফুল ঝরে যায় আশঙ্কা থাকে, তাই যাতে মাটি স্বাভাবিক থাকে সেই অনুযায়ী পানি দিতে হবে। এছাড়াও গাছে ফুল থেকে লিচু যখন একটু বড় বড় হবে তখনও গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। সাধারনত এই সময়ে লিচু গাছের গোড়ায় পানি দিলে ফল আরো বড় হয় সাথে বেশ মিষ্টি রসালোও হয়। তবে শীতকালে বা বর্ষার সময়ে গাছের নিচে পানি দেওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না, কারণ এই সময়ে মাটি এমনিতেই ভেজা থাকে এবং গাছ সহজেই মাটি থেকে ভিটামিন সংগ্রহ করতে পারে। তাই আমাদেরকে সবসময় গাছ এবং আবহাওয়া অনুসরণ করেই যত্ন এবং পরিমাণ অনুযায়ী গাছের নিচে পানি দিতে হবে।

লিচু গাছে ফুল আসার কোন ধরনের সার দিতে হয়

লিচু গাছের বৃদ্ধির উপরে অনেকটাই নির্ভর করে তার ফুল এবং ফলন। তাই লিচু গাছে ফুল আসার আগে ভালো ফলনের জন্য অবশ্যই গাছের বৃদ্ধির দিকে আমাদেরকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সার, নিয়মিত শেষ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে প্রতিদিন পানি দিতে হবে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা লিচু গাছে ফুল আসার আগে কোন ধরনের সার দিলে বা কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সার দিলে ফুল বেশি আসবে এবং উচ্চ ফলন হবে।

সাধারণত লিচু গাছের ফুল আসার ৩০ থেকে ৪৫ দিন আগে স্যারের পরিমাণ নির্দিষ্ট অনুসারে দিতে হবে। যেহেতু একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছেই ফুল আসে, তাই ওই গাছের ক্ষেত্রে ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম টিএসপি সাথে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পটাশার ব্যবহার করলে গাছের জন্য বেশি উপকারী হবে। এগুলো গাছকে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে সহায়তা করবে। এছাড়াও এই সকল সারের সঙ্গে জৈব সার যেমন গোবর ব্যবহার করলে ফলন আরো ভালো হবে। তাই আপনি চাইলে একই সময়ে এই সকল সারের সঙ্গে ১০ কেজি পরিমাণ গবর গাছের গোড়ায় দিতে পারেন।

লিচু গাছ চারা থেকে ফুল আসার উপযোগী হতে কত সময় লাগে

সাধারণত একটি লিচু গাছের চারা থেকে ফুল আসার উপযোগী হওয়ার সময় সম্পূর্ণ নির্ভর করে ওই গাছের জাত, গাছ লাগানোর পদ্ধতি এবং তার যত্নের উপর। মূলত লিচু গাছের চারা দুই পদ্ধতিতে লাগানো যায়, কলমের গাছ আর বীজ থেকে জন্মানো গাছ। কলমের যে সকল লিচু গাছ থাকে সেগুলোতে মূলত তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই ফুল আসে এবং ফলন হয়, আর বিচি থেকে জন্মানো গাছগুলোর ক্ষেত্রে ৭ থেকে ৮ বছর বয়সের সময় ফুল আসে। 

তবে সাধারণভাবেই লিচু গাছ থেকে ফুল বা ফল পেতে কিছুটা দীর্ঘ সময় লাগে, কারণ এটির তুলনামূলকভাবে অন্যান্য গাছের চেয়ে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় দ্রুত সময়ে লিচু গাছ থেকে ফলন পাওয়ার জন্য গাছের বৃদ্ধি করতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো, পানি এবং সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করে লিচু গাছের যত্ন নেওয়া। তাই আমরা যারা লিচু চাষ করে দ্রুত ফলন আনতে চাই তাদের জন্য কলমের গাছের চারা রোপন করায় ভালো হবে।

লিচু গাছের ফুল ঝরে যাওয়ার কারণ কি

সাধারণত লিচু গাছে ফুল আসার সময় অতিরিক্ত পরিমাণে আসে কিন্তু তা ফলন পর্যন্ত পৌঁছায় না, তার আগেই অনেক ফুল ঝরে যায়। এই ফুল ঝরে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে যেমন পানি না দেওয়ার কারণে গাছের গোড়া অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যাওয়া, প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার না করার জন্য গাছে পুষ্টি সরবরাহ কমে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও লিচুর ফুল ঝরে যাওয়ার আরো একটি প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। 

আরো পড়ুনঃ বড়দের খিচুনি হওয়ার ৫টি কারণ

যেহেতু লিচু গাছে ফুল আসে ফাল্গুন মাসের দিকে এবং ফুল থেকে ছোট ছোট ফল পরিণত হয় গ্রীষ্মের সময় গিয়ে। এই সময় দেখা যায় কাছের বেশিরভাগ ফুল পড়ে যায় বাতাসের কারণে। মূলত বাতাসের কারণে গাছের ফুল পরা প্রতিরোধ করা সম্ভব না। তবে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে লিচু গাছে কখন ফুল আসে এর ওপর। এছাড়াও অন্যান্য যে যে কারণগুলো রয়েছে সেগুলো বিষয় কিছু সচেতনতা অবলম্বন করে ফুল পড়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।

লিচুর ফুল ঝরা প্রতিরোধে করণীয়

অনেক সময় দেখা যায় একটি গাছে প্রচুর পরিমাণে লিচুর ফুল আসে। কিন্তু তা ফলন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে না তার আগেই অনেক কারণবশত ঝরে যায়। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকে যেমন আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে যাওয়া, গাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ না হওয়া ইত্যাদি। লিচু গাছের ফুল ঝরে যাওয়া প্রতিরোধ করার বেশ কয়েকটি কার্যকরী উপায় রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল গাছের প্রতি যত্নশীল হওয়া। যেহেতু গাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ না হওয়ার কারণে লিচুর ফুল ঝরে যায়, তাই আমাদেরকে গাছের শুষ্কতা দূর করতে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির সরবরাহ করার জন্য ফুল আসার ২০ থেকে ৩০ দিন আগেই গাছের নিচে প্রতিদিন দুই বেলা করে পর্যাপ্ত পানি দেওয়া উচিত। 

এতে করে গাছের গোড়ায় সবসময় আদ্রতা বজায় থাকবে এবং শুষ্কতার ভাব দূর হবে। পাশাপাশি গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের জন্য নিয়মিত পানি দেওয়ার পাশাপাশি জৈব সার গোবর দিতে হবে। ফলে দেখা পানি দেওয়ার কারনে শুষ্কতা বজায় থাকবে আর জৈব সারের কারণে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারবে। এগুলো মূলত লিচু গাছের ফুল ঝরে যাওয়ার কারণ রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কোন মাটিতে লিচুর ফুল বেশি আসে

লিচু মূলত বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই চাষ করা করা হয়। কিছু আসলে বেশি আবার কিছু অঞ্চলে একটু কম। মূলত এর প্রধান কারণ হলো মাটির উর্বরতা। যে সকল অঞ্চলে মাটির জলবায়ু ভালো এবং শুষ্কতা কম ওই সকল অঞ্চলে লিচুর ফলন বেশি হয়।যেমন বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলগুলোতে। তবে লিচু গাছে কখন ফুল আসে এবং কোন সময় কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে ভালো ফলন আনা সম্ভব এ বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করে লিচু চাষ করলে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে লিচুর উচ্চ ফলন আনা সম্ভব।

লেখকের শেষ কথা

আমাদের দেশের বাগান গুলোতে লিচুর ফুল প্রতিবছর একই সময়ে সাধারণত আসে না, কোনসময় চৈত্র মাসের শুরুতে আসে আবার কোন সময় চৈত্র মাসের শেষে আসে। কিছুদিন পার্থক্যের মধ্যেই লিচু গাছে ফুল আসে। তবে আমরা যদি গাছের নির্দিষ্ট যত্ন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে সূর্যের আলোর ব্যবস্থা করে দেই তাহলে প্রতিবছরই ফুল এসে ফলন হওয়ার আশা থাকে। তাই আমাদের উচিত গাছের প্রতি সারা বছরই যত্নশীল হওয়া, গাছের গোড়া সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যাতে ফলনের সময় ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি লিচু গাছে কখন ফুল আসে এ বিষয়ে জানতে পেরেছেন। এরকম আরো বিভিন্ন তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।37912